আশফাক সাহেব নিজের প্রতি অত্যন্ত সংবেদনশীল। তার একমাত্র ছেলে তন্ময়ের জন্য তিনি একটি সম্ভ্রান্ত পরিবারের বিয়ের প্রস্তাব মেনে নেন। মেয়েটি মেধাবী, আত্মবিশ্বাসী এবং উচ্চশিক্ষিত। তবে, বিয়ের অনুষ্ঠানের পূর্বমুহূর্তে মেয়েটি জানতে পারে, আশফাক সাহেব তার পরিবারের আর্থিক অবস্থা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন এবং পণ হিসেবে একটি বড় অঙ্কের অর্থ দাবি করেছেন। তখন মেয়েটি পরিবারের সকলের আপত্তি উপেক্ষা করে নিজেই সামনে এসে যোষণা করে, "একজন মানুষের মর্যাদা এবং সম্পর্ক অর্থের উপর নির্ভরশীল হতে পারে না। আমি এমন কোনো সম্পর্কে জড়াতে চাই না, যেখানে আত্মসম্মান নেই।" মেয়েটি বিয়ের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে এবং নিজের সিদ্ধান্তে অটল থাকে।
শহরের এক তরুণ চিকিৎসক রাফি। তার সফল ক্যারিয়ার ছেড়ে গ্রামের দরিদ্র মানুষের সেবা করতে একটি গ্রামে চলে যায়। ঐ গ্রামের মানুষজন দীর্ঘদিন ধরে চিকিৎসার অভাব অনুভব করছিল। রাফি নিজের উপার্জনের টাকা দিয়ে সেখানে একটি ছোট্ট ক্লিনিক তৈরি করে। সে বিনামূল্যে চিকিৎসা ও ঔষধ বিতরণ করতে থাকে। সময়ের সাথে তার এই উদ্যোগের কথা আশেপাশের গ্রামগুলোতে ছড়িয়ে পড়ে। গ্রামের মানুষ তাকে মানবতার চিকিৎসক বলে ডাকতে শুরু করে। রাফি মনে করে, মানব-কল্যাণ মানে শুধু দান-খয়রাত নয়; মানব-কল্যাণ মানে মানুষের স্বাস্থ্যের উন্নতি, মর্যাদা রক্ষা এবং আত্মনির্ভরশীল করে গড়ে তোলা।
চারিদিকে যখন আকালের ভয়াবহতা তখন জয়গুন তার সন্তানদের নিয়ে বেঁচে থাকার লড়াই শুরু করে। সন্তানদের কথা ভেবে সমস্ত সংকোচ ও লোকলজ্জা পেছনে ফেলে কাজ খুঁজতে থাকে জয়গুন। গ্রামে কোনো কাজ না পেয়ে সে শহরে একটি খাবার হোটেলে কাজ নেয়। দিন-রাত পরিশ্রম করে যা পায়, তা দিয়ে সে সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ চালায়। সন্তানদের উচ্চ শিক্ষা ও নিরাপদ জীবনে পৌঁছে দেওয়ার জন্য সে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। কাজ শেষে অনেক রাতে সে বাড়িতে ফেরে। নানা লোকের নানা কথা, তাদের হাসি-তামাশা, তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য আর অপমান কিছুই তাকে তার সংকল্প থেকে সরাতে পারেনি।
মুক্তিযুদ্ধের সময় কিশোরী রাবেয়া মা ও ছোটো ভাইকে নিয়ে একটি গ্রামে আশ্রয় নেয়। চারিদিকে পাকিস্তানি বাহিনীর তাণ্ডব, লুটপাট আর নারীদের উপর ভয়াবহ নির্যাতনের খবর ছড়িয়ে পড়ে। একদিন গ্রামে হানাদার বাহিনী হানা দেয়। রাবেয়ার মা তাকে বলে "তুই পালা, মা! তুই বাঁচতে পারলে আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন বেঁচে থাকবে।” রাবেয়া পালিয়ে মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগ দেয় এবং শত্রুর বিরুদ্ধে লড়াই চালিয়ে যায়। মায়ের আত্মত্যাগ আর স্বাধীনতার স্বপ্ন তাকে বারবার সাহস যোগায়।
মানুষ বাঁচে তার কর্মের মধ্যে, বয়সের দ্বারা নয়। এমনই একজন অমর শিল্পী ছিলেন লিওনার্দো দা ভিঞ্চি। তাঁর আঁকা অনেকগুলো চিত্রকর্মের মধ্যে একটি মোনালিসা, যা আজও শিল্পপ্রেমীদের মুগ্ধ করে রাখে। ১৫১৯ সালে লিওনার্দো দা ভিঞ্চি মারা গেলেও আজও আমাদের মাঝে বেঁচে আছেন। তাঁর আঁকা মোনালিসার ভুবনমোহিনী অবিনশ্বর হাসি আজও তাঁর সৃষ্টির এক বিরাট রহস্য।
অধ্যবসায়ী, সাহসী, প্রতিবাদী, পরোপকারী এমন সর্বগুণের অধিকারী হিসেবে সুহাস তার প্রতিবেশীদের কাছে সুপরিচিত। বয়স্করা বলতেন, "আহা! এমন সোনার টুকরো ছেলে যদি ঘরে ঘরে জন্মাতো!" কিন্তু হঠাৎ একদিন মাদক গ্রহণের অপরাধে সুহাসকে পুলিশ ধরে নিয়ে যায়। এই ঘটনায় সকলে বিস্মিত। কান্নাজড়িত কণ্ঠে সুহাসের মা বলেন, "কিছুদিন ধরে অপরিচিত একটা ছেলে ওর সাথে দেখা করতে আসত। আমার ছেলের এত বড় সর্বনাশ হবে ভাবতে পারিনি।"
মা'কে হারিয়ে মিজানের মন খুব খারাপ। প্রিয় বন্ধু জাহিন এসে বলল, "তুমি নৌকায় ঘুরতে খুব পছন্দ কর, চলো আমরা দু'দিনের জন্য নৌকা-ভ্রমণে যাই। ভরা তিস্তায় ঘুরতে ভালো লাগবে। দুধারে কাশফুল, শুভ্র মেঘের আড়ালে নির্মল জ্যোৎস্নায় আমরা নৌকায় রাত্রিযাপণ করব।" মিজান নির্বাক হয়ে তাকিয়ে থাকল জাহিনের দিকে। একটু থেমে বলল, "আকাশের চাঁদ, নদীর কুলুধ্বনি কিছুই ভাবতে পারি না বন্ধু! আমার সমস্ত ভালোলাগা পৃথিবী থেকে বিদায় নিয়েছে।"
শিক্ষিত মেয়ে রাশেদা বিয়ের পর শ্বশুর বাড়িতে এসে দেখতে পায় গ্রামের লোকেরা নানা কু-সংস্কারে আচ্ছন্ন। অশিক্ষিত ও সরল ধর্মপ্রাণ মানুষগুলো নানাভাবে সিরাজ মাতব্বরের শোষণের শিকার। পূর্বপুরুষের একটি কবরকে মাজার ঘোষণা দিয়ে ভয় দেখিয়ে গ্রামের সাধারণ মানুষদের শোষণ করে। নারীর স্বাধীনতা কেড়ে নেয় এবং নারীকে ঘরেবন্দি থাকতে বাধ্য করে। এ সব দেখে রাশেদা প্রতিবাদী হয়ে উঠে। একদিন সিরাজ এক নিরীহ নারীকে অপবাদ দিয়ে গ্রাম থেকে বের করে দেওয়ার চেষ্টা করলে রাশেদা তারও বিরুদ্ধে দাঁড়ায়। তার সাহস আর দৃঢ়তায় গ্রামের মানুষজন একত্রিত হয় এবং সিরাজের ভণ্ডামি ও ষড়যন্ত্রের মুখোশ খুলে দেয়।
তিস্তা নদীর চরাঞ্চলের মানুষেরা নিত্যই অভাব-অনটন নিয়ে বসবাস করে। দিনের পর দিন আসে কিন্তু হতভাগ্য এ অঞ্চলের মানুষদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন আসে না। বৎসরান্তে তিস্তার অপ্রতিরোধ্য ভাঙন মানুষকে আরও বেশি অসহায়, নিঃস্ব করে ফেলে। শস্যহীন মানুষগুলো ক্ষুধা-তৃষ্ণা, রোগ-শোক, শিশুর আর্তচিৎকার, সব মিলে আনন্দহীন এক মানবেতর জীবন অতিবাহিত করে। এদের মধ্যে সলেমান ব্যতিক্রম। সে সাহসী, সংগ্রামী ও কূটবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষ। সলেমান উত্তরবঙ্গে কৃষিসমৃদ্ধ একটি গ্রামে কবিরাজি ব্যবসায় শুরু করে। গাছ-পালার শিকড়-বাকর ও তাবিজ-কবজ বিক্রি করে সে বিপুল অর্থ ও সম্মান অর্জন করে। সরল গ্রামবাসী তাকে 'জ্বিনের বাদশা' মনে করে।
রায়বাড়ির অভিজাত নারী বনশ্রী ছিলেন পরিবারের সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তি। তিনি পরিবারের ঐতিহ্য ও সম্মান রক্ষায় ছিলেন দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। কিন্তু ধীরে ধীরে ক্ষমতা ও সম্পদের প্রতি তার লোভ বেড়ে যায়। সম্পত্তির দখল নেওয়ার জন্য তিনি তার আপন ভাই সতীশকে বিশ্বাসঘাতকতার ফাঁদে ফেলেন। স্নেহ-ভালোবাসার মুখোশ পরে সে প্রথমে সতীশকে আপন করে নেয়। সতীশের সরলতার সুযোগ নিয়ে প্রভাবশালীদের নিজের দলে টানে। আপন বোনের বিশ্বাসঘাতকতায় সতীশ পৈতৃক ভিটা থেকে বিতাড়িত হয়।
নীলকরদের অত্যাচার থেকে প্রজাদের রক্ষা করতে গিয়ে দেশপ্রেমী অনেক বাঙালি জমিদার সর্বশান্ত হয়েছেন। সে সময়ে স্বরপুর গ্রামের কৃষকদের রক্ষা করার ব্রত নিয়েছিলেন কৃষকপুত্র নবীন মাধব। কখনো মামলা করে, 'কখনো বা অসীম সাহসে লড়াই করে অত্যাচারী নীলকরদের হাত থেকে তিনি কৃষকদের রক্ষা করেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে নীলকর সর্দার উড সাহেব গোপীনাথ নামক এক বাঙালি কর্মচারীকে ঘাতক হিসেবে নিযুক্ত করেন। বিপুল অর্থ আর উচ্চ পদমর্যাদা লাভের আশায় গোপীনাথ নবীন মাধবকে নির্মমভাবে হত্যা করে। এভাবে ঘরের শত্রুর কাছে দেশপ্রেমের পরাজয় ঘটে।