Job

রচনা লিখুন: দুর্নীতি ও তার প্রতিকার

dsuc.created: 2 years ago | dsuc.updated: 1 year ago
dsuc.updated: 1 year ago

দুর্নীতি ও তার প্রতিকার

ভূমিকাঃ সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বিষবাষ্পের মতো ছড়িয়ে পড়া সর্বগ্রাসী দুর্নীতির ভয়াল কালো থাবায় বিপন্ন আজ মানবসভ্যতা। বাংলাদেশে যেসব সামাজিক সমস্যা রয়েছে তার মধ্যে দুর্নীতি সবচেয়ে মারাত্মক কারণ এই ব্যাধি মানসিক এবং তা সারানো খুব কঠিন কাজ। দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষানীতি, সংস্কৃতি, শিল্প, ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সর্বত্রই চলছে দুর্নীতি।

দুর্নীতির পরিচয়ঃ দুর্নীতি শব্দটির অর্থ ‘নীতিবিরুদ্ধ, কুনীতি বা অসদাচরণ'। স্বাভাবিক ভাবে যা নীতি সমর্থিত নয় তাকেই দুর্নীতি বলা হয়। দুর্নীতি সমাজের প্রচলিত নীতি, আদর্শ ও মূল্যবোধের পরিপন্থী বিশেষ ধরনের অপরাধমূলক আচরণ । দুর্নীতিকে Social Work Dictionary তে সংজ্ঞায়িত করেছে এভাবে "রাজনৈতিক ও সরকারি প্রশাসনে দুর্নীতি বলতে অফিস-আদালতকে ব্যক্তিগত লাভের জন্য অপব্যবহার করাকে বোঝায়। সাধারণত ঘুষ, বলপ্রয়োগ বা ভয়প্রদর্শন, প্রভাব এবং ব্যক্তিবিশেষকে বিশেষ সুবিধা প্রদানের মাধ্যমে গণ প্রশাসনের ক্ষমতা অপব্যবহারের দ্বারা ব্যক্তিগত সুবধিা অর্জনকে
দুর্নীতি বলে” ।

বাংলাদেশে দুর্নীতির চিত্রঃ 'দুর্নীতিতে শীর্ষে বাংলাদেশ' এটা ছিল ২০০১ থেকে ২০০৫ সালের দৈনিক পত্রিকাগুলোর প্রধান শিরোনাম। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল (টিআই) এর রিপোর্টে বাংলাদেশ পর পর পাঁচবার দুর্নীতিতে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে। বাংলাদেশ সীমাহীন দুর্নীতির আবর্তে নিমজ্জিত। বাংলাদেশের সর্ব স্থানে দুর্নীতি দেখা যায়। সরকারী সম্পত্তি অবৈধভাবে দখল, ঋণ খেলাপি, গ্যাস-বিদ্যুৎ-পানি চুরি করে অবৈধভাবে ব্যবহার, আয়কর ও শুল্ক ফাঁকি দেওয়া, চাকরির নামে লক্ষ লক্ষ টাকা আত্মসাৎ, শেয়ার বাজারের দরপতন, চোরাচালানি, কালোবাজারি ইত্যাদি সহ সর্বক্ষেত্রে আজ দুর্নীতি বিরাজ করছে। দুর্নীতির ভয়াল ছোবলে বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জীবন আজ জর্জরিত। রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি, শিক্ষা, সংস্কৃতি, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, শাসন বিভাগ সহ সব কিছুতেই রয়েছে দুর্নীতি। চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, মামলাবাজি, টোলবাজি ইত্যাদি রকমের দুর্নীতিতে আজ সারা বাংলা ছেয়ে গেছে ।

দুর্নীতির প্রকারঃ দুর্নীতিকে আমরা তিনটি দিক থেকে দেখতে পারি। প্রথমত, রাজনৈতিক ক্ষমতাসীন ব্যক্তিদের দুর্নীতি। যে ব্যক্তি ক্ষমতা হাতে পায় সেই ক্ষমতার অপব্যবহার করে। ক্ষমতাসীন ব্যক্তিরা সবাইকে তাদের হাতের মুঠোয় নিয়ে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। সকলের ওপর তাদের কর্তৃত্ব থাকে। তাই তারা নির্বিঘ্নে দুর্নীতি করতে পারে। তাদেরকে কারো কাছে
জবাবদিহি করতে হয় না ৷

দ্বিতীয়ত, অফিসের কর্মকর্তা বা কর্মচারিদের দুর্নীতি। যারা বিভিন্ন অফিস আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারি তারাও ক্ষমতার অপব্যবহারের মাধ্যমে দুর্নীতি করে। প্রাচীন অর্থশাস্ত্রের লেখক কৌটিল্য বলেছেন-জিহ্বার ডগায় মধু রেখে সেটার স্বাদ কেউ নেবে না এমন যেমন হয় না, তেমনি সরকারি তহবিল যার দখলে থাকে সেও তা আত্মসাৎ করবে না এমনও হয় না ।

তৃতীয়ত, ব্যক্তিগত দুর্নীতি। ক্ষমতাসীন ব্যক্তি ও অফিস-আদালতের কর্মকর্তা-কর্মচারিদের দুর্নীতির বাইরে যে সমস্ত দুর্নীতি হয় সেগুলো হলো ব্যক্তিগত দুর্নীতি। এসব দুর্নীতি ব্যক্তিগত পর্যায়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে ঘটে থাকে। যেমন কারো জায়গা জমি, অর্থ আত্মসাৎ করা, প্রতারণা করা ইত্যাদি ।

দুর্নীতির কারণঃ যখন কোনো দেশ ও সমাজের সামাজিক ও অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্বল হয়, মানুষের মধ্যে নীতি নৈতিকতার অভাব হয় তখন দুর্নীতি হয়। সমাজে কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গোষ্ঠীর হাতে এককভাবে ক্ষমতা কেন্দ্রীভূত এবং তারা সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য এককভাবে ক্ষমতা প্রাপ্ত হলেও সেখানে দুর্নীতি হয়। সমাজে জবাবদিহিতার অভাব থাকলে এবং রাষ্ট্রীয় কাজে কিংবা যেকোনো সাধারণ কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিদের বেতন যখন পর্যাপ্ত নয় সেখানে দুর্নীতি হয়। দেশের শাসন, আইন ও বিচার বিভাগ দুর্বল হলে এবং সেখানে কোনো স্বচ্ছতা না থাকলে মানুষ দুর্নীতি করে। আবার যে সমাে স্বাধীন-গণমাধ্যম থাকে না, সক্রিয় একটি সুশীল সমাজ থাকে না সেখানেও দুর্নীতি অনেক বেশি হয়। দুর্নীতি প্রতিরোধী সঠিক ও কার্যকরী আইনের প্রয়োগের অভাবেও দুর্নীতি হয় । এছাড়া মানুষের  দারিদ্র্য আর অর্থনৈতিক  অসচ্ছলতাও দুর্নীতির অন্যতম কারণ।

দুর্নীতির প্রতিক্রিয়াঃ দুর্নীতি সমাজের জন্য সব সময়ই নেতিবাচক। দুর্নীতির কারণে সমাজের সার্বিক উন্নতি ও প্রবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হয়। ফলে আমাদের জাতীয় অগ্রগতি বিঘ্নিত হয়। দুর্নীতির ফলে সমাজের সুবিধাবাদী ও ক্ষতিকর ব্যক্তিদের হাতে অর্থ ও সম্পদ পুঞ্জীভূত হয়। ফলে এক সময় অর্থের প্রভাবে ক্ষমতা ও কর্তৃত্ব তাদের হাতে চলে যায়। এতে করে তারা ক্ষমতার অপব্যবহার করে সমাজের অর্থনীতি ও উন্নয়নকে নিয়ন্ত্রণ করে ও নিজেদের সুবিধামত ব্যবহার করে। দুর্নীতির ফলে দেশে কালো টাকার পাহাড় গড়ে ওঠে। যা বিদ্যমান অর্থনীতির উপর বিরূপ প্রভাব ফেলে। দুর্নীতিবাজরা দেশের অর্থসম্পদ লুট করে বিদেশে পাচার করে। দুর্নীতির কারণে দেশে স্থানীয় ও আন্তর্জাতিক বিনিয়োগ বাধাপ্রাপ্ত হয়। ফলে উৎপাদন ব্যবস্থ ব্যাহত হয়। এতে করে পণ্যের সরবরাহ কমে যায় আর দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি পায়। সাধারণ মানুষের ক্রয় ক্ষমতা হ্রাস পায়। দুর্নীতি দেশকে আরো বেশি দরিদ্র করে ফলে। দেশের সামাজিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থাকে বিপর্যস্ত করে।

দুর্নীতির কারণে দেশের ক্ষতির চিত্রঃ

বিশেষজ্ঞগন দুর্নীতিকে বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়নের সবচেয়ে বড় অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করেছেন। দুর্নীতির কারণে বাংলাদেশের উন্নয়ন পিছিয়ে পড়লেও দুর্নীতি কমছে না। দুর্নীতি সমাজে সৃষ্টি করছে চরম অস্থিতিশীলতা।

বাংলাদেশে প্রতি বছর প্রায় ৪০০ কোটি টাকার বিদ্যুৎ চুরি হয়। চুরি ছাড়াও সিস্টেম লসের কারণে বিদ্যুৎ খাতে ক্ষতি হয় আরো ৫০০ কোটি টাকার মতো। বিদ্যুৎ সুবিধার অপ্রতুলতার কারণে অর্থাৎ লোডশেডিং, অনিয়মিত বিপুল সরবরাহের কারণে শিল্প খাতের উৎপাদনে লোকসান হচ্ছে প্রায় ৬০০০ কোটি টাকা ।

  • বিদ্যুতের মতো গ্যাসও মানুষ চোরাই লাইন নিয়ে ব্যবহার করে থাকে। গ্যাস খাতে সিস্টেম লস হয় বছরে প্রায় ৫০০ কোটি টাকা।
  • সরকারি ক্রয়েও দুর্নীতি হয় সবচেয়ে বেশি। বর্তমানে বালিশ কেলেঙ্কারি, পর্দা কেলেঙ্কারির মতো ঘটনা ঘটছে। 
  • পেট্রোলিয়াম খাতে শুধু পাচারের কারণে বছরে ৪০০ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হচ্ছে।
  • ঘুষ প্রদান ছাড়া সরকারি ফাইল নড়ে না।
  • দেশের আমদানি-রপ্তানীর ক্ষেত্রেও প্রচুর দুর্নীতি হয়। আমদানীর ক্ষেত্রে অতিরিক্ত মূল্য দেখিয়ে টাকা পাচার করা হয় আবার রপ্তানীর ক্ষেত্রে অল্প মূল্য দেখিয়েও শুল্ক ফাঁকি দেওয়া হয় ৷
  • চট্টগ্রাম বন্দর অব্যবস্থাপনার কারণে বছরে প্রায় ৬০০০ কোটি টাকার লোকসান হচ্ছে।
  • সরকারি বিভিন্ন কাজ পাওয়ার ক্ষেত্রে ঘুষ প্রদান করতে হয়ে।
  • রাস্তা তৈরি করতেও দুর্নীতি চলছে। রাস্তায় সঠিক পরিমাণে উপকরণ দেওয়া হয়না ।
  • প্রতিবছর হরতাল ও রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার কারণে উৎপাদন ও রপ্তানি ক্ষেত্রে কয়েক হাজার কোটি টাকার লোকসান হচ্ছে
  • বাংলাদেশের উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ টাকা উন্নয়নে ব্যয় না হয়ে অধিকাংশ টাকাই আমলাদের পকেটে ঢুকে যাচ্ছে ।

দুর্নীতির কারণে আরো যেসকল ক্ষতি হয়ঃ

জনগনের বিড়ম্বনা বৃদ্ধি করে; সরকারি সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রিতা তৈরি হয়; জনগন তাদের ন্যায্য অধিকার থেকে বঞ্চিত হয়; সরকারের প্রতি জনগনের শ্রদ্ধা ও আনুগত্য হ্রাস পায়; আন্তর্জাতিক অঙ্গনে দেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ হয়; সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি হয়; প্রশাসনিক দক্ষতা হ্রাস পায়; জনগন তার ন্যায় বিচার থেকে বঞ্চিত হয়; নাগরিক সুবিধা থেকে বঞ্চিত হয় ইত্যাদি ।

দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে আমাদের করনীয়ঃ

দুর্নীতি আজ সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রে বিদ্যমান। সমাজ থেকে দুর্নীতির ব্যাধিকে দূর করা সরকারের একার পক্ষে সম্ভব নয় ৷ এই সমস্যার সমাধানের জন্য সামাজিক আন্দোলনের প্রয়োজন। সরকারের গ্রহনীয় পদক্ষেপের পাশাপাশি আমাদের যা যা করতে হবে তা নিম্নে দেওয়া হলো:

বিচার ব্যবস্থাকে দুর্নীতি মুক্ত করতে হবে।

আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করতে হবে ।

স্বাধীন দুর্নীতি দমন কমিশনের সক্রিয় ভূমিকা রাখতে হবে।

সাংবিধানিক সরকার ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে।

মানুষের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করতে হবে।

দুর্নীতি মুক্ত পরিবার গঠন করতে হবে ।

কোথায় দুর্নীতি হলে তা সক্রিয়ভাবে প্রতিরোধ করতে হবে। 

আদর্শ শিক্ষায় শিক্ষিত হতে হবে।

দুর্নীতির ভয়াবহ কুফল ও পরিণতি সম্পর্কে সকলকে অবহিত করতে হবে।

সৎ, যোগ্য, দায়িত্বশীল নাগরিক তৈরির জন্য রাষ্ট্রীয় পরিকল্পনা থাকতে হবে।

সরকারি-বেসরকারি চাকরির নিয়োগের ক্ষেত্রে ও পদোন্নতির ক্ষেত্রে মেধা, যোগ্যতা, দক্ষতা ও সততার মানদ- রক্ষা করতে হবে। 

পক্ষপাত ও স্বজনপ্রীতি বর্জন করতে হবে।

সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য পদমর্যাদা ও দ্রব্যমূল্য অনুযায়ী সম্মানজনক জীবন-জীবিকার উপযোগী বেতন-ভাতা নির্ধারণ করা প্রয়োজন ।

নিরপেক্ষ অডিট ব্যবস্থা, স্বচ্ছ মনিটরিং পদ্ধতি, স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চতকরণ ও সুস্পষ্ট নীতিমালা প্রণয়ন করতে হবে।

দুর্নীতি দমন কমিশনকে রাজনৈতিক ও প্রশাসনিক প্রভাব মুক্ত রাখতে হবে।

দুর্নীতি মুক্ত রাষ্ট্র ও প্রশাসন ব্যবস্থা গড়ে তোলার জন্য স্বল্পমেয়াদি, মধ্যমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা গ্রহণ করতে হবে ।

দুর্নীতির কারণ উদঘাটন করে তা প্রতিকারের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে ।

সংবাদপত্রের স্বাধীনতা দিতে হবে।

প্রশাসনিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে হবে।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে জনসচেতনতা তৈরি করার জন্য ইলেক্ট্রনিক ও প্রিন্ট মিডিয়ায় প্রচার-প্রচারণা চালাতে হবে ।

উপসংহারঃ দুর্নীতি আমাদের জাতীয় উন্নয়নে সবসময়ই প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করেছে। দুর্নীতি যেমন আমাদের অর্থনীতির মেরুদন্ডকে বিপর্যস্ত করেছে তেমনি বিশ্বের কাছে সেরা দুর্নীতিগ্রস্ত দেশ হিসেবে আমাদের ভাবমূর্তিকে নষ্ট করেছে। দুর্নীতিকে সমাজ থেকে চিরতরে দূর করার জন্য প্রয়োজন সম্মিলিত উদ্যোগ। আমাদেরকে তৈরি করতে হবে দুর্নীতি বিরোধী জাতীয় আন্দোলন। আর সচেতনভাবে সেখানে সর্বস্তরের মানুষের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। তবেই আমরা দুর্নীতি প্রতিরোধে সক্ষম হতে পারব।

1 year ago

বাংলা

Please, contribute to add content.
Content
Promotion