বাংলাদেশের টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে, এসএমই কে একটি অগ্রাধিকারপ্রাপ্ত খাত হিসেবে তৈরি করার জন্যে কি কি কৌশল ব্যবহার করা যেতে পারে?
বাংলাদেশের আর্থসামাজিক প্রেক্ষাপটে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প একটি গুরুত্বপূর্ণ খাত। অভ্যন্তরীণ বাজারে দৈনন্দিন প্রয়োজনের পণ্যসামগ্রীর সরবরাহ ক্ষুদ্র ও মাঝারি খাত থেকে আসে। অথচ এ খাতটি অনেকটাই অবহেলিত। এর বিকাশ ঘটালে কর্মসংস্থানের বড় ক্ষেত্র তৈরিসহ দারিদ্র্যদূরীকরণে অনন্য অবাদান রাখতে পারে। এ খাতের উদ্যোক্তাদের পুঁজি কম, আয়ও কম । প্রয়োজনীয় পুঁজি, অর্থায়ন ও বাজার সম্প্রসারণের সুযোগ পেলে জাতীয় অর্থনীতিতে এসএমই নিঃসন্দেহে ভালো ভূমিকা পালন করতে পারে ।
এসএমই বলতে মূলত কটেজ, মাইক্রো, স্মল অ্যান্ড মিডিয়াম এন্টারপ্রাইজ অর্থাৎ একে সিএম-এসএমই বলা হয় । কটেজ ও মাইক্রো শিল্প খাতে স্বল্প পুঁজিতে ব্যাপক কর্মসংস্থানের সুযোগ রয়েছে। বাংলাদেশের জিডিপিতে ২০-২৫ শতাংশ অবদান এসএমই খাতের। কিন্তু দেশে এসএমই খাত বিশ্বের অন্যান্য দেশের তুলনায় কাঙ্ক্ষিত ভূমিকা পালন করতে পারছে না। ইউরোপীয় ইউনিয়নের দেশগুলোর জিডিপিতে এসএমই খাতের অবদান ৫৫ শতাংশ। ভারতে ৪৫ শতাংশ। চীন, জাপান, দক্ষিণ কোরিয়ার জিডিপিতে ৬০-৭০ শতাংশ অবদান রাখছে। ২০১৩ সালের বাংলাদেশের শিল্পনীতি-২০১৬ সালের সংজ্ঞা অনুয়ায়ী, ১৬ থেকে ৩০০ জন পর্যন্ত কর্মীর প্রতিষ্ঠান অণু, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের অন্তর্ভুক্ত। ২০১৯ সালে শিল্প খাতে জরিপ অনুযায়ী, দেশে ৪৬ হাজার ২৯১টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান আছে, যার ৯৩ ভাগই ক্ষুদ্র ও মাঝারি । বাংলাদেশ ক্ষুদ্র, কুটির শিল্পপ্রতিষ্ঠান (বিসিক) ১৯৫৭ সাল থেকে এ খাতে কাজ করছে। বাংলাদেশ ব্যাংক ২০০৪ সাল থেকে এসএমই খাতে পুনঃঅর্থায়নের কর্মসূচি হাতে নেয়। ২০০৯ সালে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রধান কার্যালয়ে ‘এসএমই অ্যান্ড স্পেশাল প্রোগ্রামস ডিপাটমেন্ট' নামে একটি বিভাগ খোলা হয় । ২০১০ সালে বিস্তৃত এসএমই ঋণনীতিমালা প্রণয়ন করা হয় । সাথে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানকে এসএমই নীতিমালার আওতায় এনে এ খাতে বিনিয়োগ প্রদানে উদ্বুদ্ধ করা হয়। বাংলাদেশ ব্যাংক, পিকেএসএফ এবং এসএমই ফাউন্ডেশন মূলত এসএমইতে ঋণ বিতরণের কাজ করছে। বিসিকের ভূমিকা তো আছেই । কটেজ মাইক্রো, ক্ষুদ্র ও মাঝারি (সিএম-এসএমই) উদ্যোক্তার মধ্যে ২০২০-২০২১ অর্থবছরে ১০০ কোটি টাকা ঋণ বিতরণ করে এসএমই ফাউন্ডেশন। এসএমই ফাউন্ডেশনের তথ্য, বিতরণ করা ঋণের ৬৬ দশমিক ৭৫ শতাংশ পুরুষ উদ্যোক্তা এবং ৩৩ দশমিক ২৫ শতাংশ ঋণ নারী উদ্যোক্তাদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। বিতরণ করা ঋণের ৮০ দশমিক ২৪ শতাংশ উদ্যোক্তা ঢাকার বাইরের। সম্প্রতি এসএমই ফাউন্ডেশন ১৯টি ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানের সাথে চুক্তি করেছে। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে দ্বিতীয় পর্যায়ে প্রণোদনার ২০০ কোটি টাকার বরাদ্দ দেয় অর্থ বিভাগ। দেশের পল্লী ও প্রান্তিক পর্যায়ের উদ্যোক্তাদের কাছে প্রণোদনার অর্থ পৌঁছে দিতে এসএমই ফাউন্ডেশনের উদ্যোগ প্রশংসনীয় হলেও যথেষ্ট নয়। সার্বিকভাবে অর্থয়ানে মূল স্রোতধারায় এসএমই খাত আসতে পারেনি। বিনিয়োগ উন্নয়নের মূলধারায়ও আসতে পারেনি।
যেকোনো দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোগ (এসএমই) খুব গুরুত্বপূর্ণ। শিল্পোন্নয়ন তথা বৃহৎ শিল্পের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প বিকাশ লাভ করে। এটা শিল্পায়নের অগ্রণী চাহিদা মেটায়, রপ্তানির চাহিদা মেটায় এবং সর্বোপরি প্রবৃদ্ধি এবং আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন ত্বরান্বিত করে। তাই বড় বড় শিল্পের সঙ্গে ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পকে কোনোভাবেই ছোট করে দেখার সুযোগ নেই ।
বিভিন্ন কারণে এই খাতকে গুরুত্ব দিতে হবে। কারণগুলো হচ্ছে প্রথমত, এসএমএই খাতে বর্তমানে একটা বিশাল জনগোষ্ঠী জড়িত। দ্বিতীয়ত, এই খাতের দ্রুত বিকাশ লাভ করার সম্ভাবনা রয়েছে। তৃতীয়ত, এসএমই খাতের পণ্য গুণে-মানে কোনো অংশেই কম নয় । এরা এখন আগের চেয়ে অনেক বেশি প্রযুক্তিনির্ভর। এ খাত আয়বর্ধক খাত হিসেবে চিহ্নিত। যারা চাকরি করতে চায় না বা করে না, শিক্ষিত বা অল্প শিক্ষিত-তাদের সবারই একটা সুযোগ থাকে এখানে কিছু করার। চতুর্থত, কর্মসংস্থান সৃষ্টির একটা বড় সুযোগ ও ক্ষেত্র হচ্ছে এসএমই খাত। সার্বিকভাবে দারিদ্র্য বিমোচনের বড় একটা হাতিয়ার এটা । আমাদের সর্বশেষ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা এবং প্রেক্ষিত পরিকল্পনায়ও এই খাতের ওপর যথেষ্ট গুরুত্ব দেওয়া হয়েছে। যথাযথ নীতি-কৌশল প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের মাধ্যমে এই খাতকে অগ্রাধিকার দিতে হবে। সেগুলো বিস্তারিতভাবে নিচে তুলে ধরা হলো: আমাদের রাজস্ব নীতিতেই এসএমইকে বিশেষ প্রাধান্য দেওয়া হয় না। আমরা বড় বড় প্রতিষ্ঠানের কর অব্যাহতি, কর হ্রাসসহ নানা দাবিদাওয়া নিয়ে ব্যস্ত থাকি। এটা ভালো; কিন্তু সঙ্গে সঙ্গে যদি এসএমইর ওপর গুরুত্বটা দেওয়া হয় সেটা হবে উপকারী। এ জন্য রাজস্ব নীতি এসএমইমুখী করতে হবে। তদারকি ও পর্যবেক্ষণ বাড়াতে হবে। প্রাইভেট সেক্টরে ঋণ বাড়ানো মানে বড় বড় শিল্পে ঋণ বাড়াতে হবে, এমন চিন্তা থেকে সরে আসতে হবে।
দ্বিতীয়ত, নীতিমালা ও পদ্ধতিগুলোর সহজীকরণ। অনেক সময় দেখা যায়, সরকার ঢালাওভাবে কিছু নিয়ম করে, যা ছোটদের ওপরও একইভাবে প্রযোজ্য হয়। এটা করা যাবে না। ছোট ও মাঝারি উদ্যোগকে যেন সহজেই এগিয়ে নেওয়া যায়, সে ধরনের নীতিগত সহযোগিতা লাগবে ।
তৃতীয়ত, তথ্য সংগ্রহ ও প্রচারের ব্যর্থতা কাটিয়ে ওঠা। এ খাতে সরকারের কিছু নীতি ও প্রণোদনার বিষয় রয়েছে। কিন্তু সরকারের উন্নয়ন এজেন্সিগুলোবিসিক, এসএমই ফাউন্ডেশন বা বেসরকারি সংস্থা রয়েছে, এরা এসএমই-সংক্রান্ত তথ্যগুলো ঠিকঠাকভাবে প্রচার করে না। মানে ছোট ব্যবসায়ীদের সব তথ্য জানাতে হবে এবং তাদের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছানো নিশ্চিত করতে হবে। চতুর্থত প্রশিক্ষণ। একটা নতুন ব্যবসায় কী কৌশল লাগবে, ঝুঁকি বা সম্ভাবনা কেমন তা উদ্যোক্তাদের জানাতে হবে। সরকারি ও বেসরকারি পর্যায় থেকে এসব বিষয়ে কিছু ব্যবস্থা রয়েছে বটে; তবে পর্যাপ্ত নয় ।
পঞ্চমত, কারিগরি, প্রযুক্তি, বিশেষ করে তথ্য-প্রযুক্তির শিক্ষা ও প্রশিক্ষণের ওপর জোর দিতে হবে। এসব বিষয়ে ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের প্রশিক্ষণ দেওয়া, আধুনিক প্রযুক্তির সঙ্গে তাদের পরিচয় করিয়ে দেওয়া খুব দরকার। এর সঙ্গে ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর নতুন নতুন সেবা তাদের কাছে পৌঁছে দিতে হবে। এসব বাস্তবায়ন করা গেলে দেশের উন্নয়নও ত্বরান্বিত হবে ।